পিরোজপুর পোষ্ট ডেক্স : ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্টের মতোই ১৯৮৯ সালে ফ্রিডম পার্টি হামলা চালিয়েছিল ধানমন্ডি ৩২ নম্বর সড়কের বঙ্গবন্ধু ভবনে। গ্রেনেড আর গুলিবর্ষণে আবারও কেঁপে উঠেছিল ধানমন্ডি এলাকা। ’৭৫-এ বিদেশে থাকায় প্রাণে বেঁচে যাওয়া বঙ্গবন্ধুকন্যা আওয়ামী লীগ সভানেত্রী শেখ হাসিনা ছিলেন খুনিদের টার্গেটে। বঙ্গবন্ধু ভবনের ভিতরে শেখ হাসিনা রয়েছেন, তা নিশ্চিত হয়েই ফ্রিডম পার্টির সন্ত্রাসীরা ওই হামলা চালায়।
কিন্তু সে সময় শেখ হাসিনার নিরাপত্তায় থাকা নিরাপত্তা রক্ষী হাবিলদার জহিরুল হক ও কনস্টেবল জাকির হোসেন সেই হামলা প্রতিহত করে রক্ষা করেন বঙ্গবন্ধুকন্যাকে। সন্ত্রাসীদের উপর পাল্টা গুলিবর্ষণে অস্ত্রধারীরা কর্নেল ফারুক জিন্দাবাদ ফ্রিডম পার্টি জিন্দাবাদ স্লোগান দিতে দিতে পালিয়ে যায় তাদের ধানমন্ডি ২৬ নম্বর সড়কের অফিসের দিকে। এ ঘটনায় ধানমন্ডি থানায় হাবিলদার জহিরুল হক বাদী হয়ে দুটি পৃথক মামলা দায়ের করেন। ২৮ বছর পর ২০১৭ সালের ২৯ অক্টোবর মামলার রায় ঘোষণা করা হয়। এ মামলায় ফ্রিডম পার্টির ১১ জনের সাজা হয়। চারজন এখনো পলাতক। তারা প্রত্যেকেই ফ্রিডম পার্টির নেতা-কর্মী এবং লিবিয়ায় অস্ত্র ও গ্রেনেড নিক্ষেপে প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত।
ঘটনার সেই রাতে বঙ্গবন্ধু ভবনে অন্যদের মধ্যে উপস্থিত ছিলেন বর্তমানে আওয়ামী লীগের মুক্তিযুদ্ধ বিষয়ক সম্পাদক অ্যাডভোকেট মৃণাল কান্তি দাস। তিনি বলেন, ‘মধ্যরাতে আকস্মিক গোলাগুলির শব্দে বঙ্গবন্ধু ভবনসহ ধানমন্ডি এলাকা প্রকম্পিত হয়ে ওঠে। আতঙ্ক ছড়িয়ে পড়ে চারদিকে। আমরা বঙ্গবন্ধু ভবনের গেটের দিকে দেখতে পাই ১৫/২০ জনের অস্ত্রধারীকে। তারা বৃষ্টির মতো গুলিবর্ষণ করতে থাকে। আর গ্রেনেড ও বোমা বিস্ফোরণ ঘটায়। একপর্যায়ে ভবনের নিরাপত্তারক্ষীরা পাল্টা গুলি চালায়। নেতা-কর্মীরাও একজোট হয়ে তাদের ধাওয়া দিতে শুরু করি। অস্ত্রধারীরা সেসময় গুলি করতে করতে পালিয়ে যেতে থাকে। তারা বঙ্গবন্ধুর খুনি কর্নেল ফারুক, রশীদ আর ফ্রিডম পার্টির নামে স্লোগান দিতে দিতে পালাতে থাকে ধানমন্ডির ফ্রিডম পার্টির অফিসের দিকে।’
যা ঘটেছিল সেই রাতে : ১৯৮৯ সাল। ১০ আগস্ট দিবাগত মধ্যরাত। ধানমন্ডি ৩২ নম্বর সড়কের বঙ্গবন্ধু ভবন। আওয়ামী লীগ সভানেত্রী শেখ হাসিনা তখন দোতলার কক্ষে অবস্থান করছেন। ভবনের বারান্দা, নিচতলার বিভিন্ন কামরা ও বাগানে অসংখ্য নেতা-কর্মী। কেউ ঘুমিয়ে আছেন। কেউ কেউ রাজনৈতিক আলাপে ব্যস্ত। এরশাদ আমলের সেই সময়ের রাজনীতির মাঠও গরম। উদ্বেগ-উৎকণ্ঠা ছিল চারদিকে। হঠাৎ বোমার বিকট শব্দ। বঙ্গবন্ধু ভবনের মূল ফটকের সামনেই ধোঁয়ার ভরে গেছে । এরপরই মুহুর্মুহু গুলির শব্দ। বঙ্গবন্ধু ভবনের ভিতরে তখন আতঙ্ক। আবারও কি সেই ’৭৫-এর কালরাত ফিরে এলো! এমন আশঙ্কা প্রথমে নেতা-কর্মীদের মাঝে। গুলির শব্দ বন্ধ হচ্ছে না। ভবনের ভিতর থেকে দেখা যাচ্ছিল সামনের সড়কটি। সেখানে ১৫/২০ জন অস্ত্রধারী। প্রত্যেকের হাতেই চকচকে অস্ত্র। অত্যাধুনিক। বুঝতে বাকি রইল না কারা। এরা ফ্রিডম পার্টির অস্ত্রবাজ। ততক্ষণে বঙ্গবন্ধু ভবনের নিরাপত্তা রক্ষীরাও প্রাণপণ যুদ্ধ শুরু করেছে। সন্ত্রাসীদের গুলির জবাবে তারা পাল্টা জবাব দিচ্ছিল। ভবনের ভিতরের নেতা-কর্মীরা একজোট হয়ে ধাওয়া দিতে শুরু করে। নিরাপত্তারক্ষীদের পাল্টা গুলি আর নেতা-কর্মীদের ধাওয়ায় পালাতে থাকে ফ্রিডম পার্টির অস্ত্রবাজরা। তারা গুলি করতে করতে পালাতে থাকে। আশ্রয় নেয় ধানমন্ডি ফ্রিডম পার্টির অফিসে। এভাবেই সেদিন প্রাণে রক্ষা পেয়েছিলেন বঙ্গবন্ধুকন্যা শেখ হাসিনা।
১৯৮৮- এর পর বাংলাদেশের পাঁচটি সংসদ নির্বাচনে সন্ত্রাসীদের রাজনৈতিক দল ফ্রিডম পার্টি অংশ নেয়। কুড়াল মার্কা নিয়ে বঙ্গবন্ধুর খুনিদের দল ফ্রিডম পার্টির মোট ২৩৪ জন প্রার্থী এই নির্বাচনগুলোয় অংশ নিয়েছিল। ফ্রিডম পার্টির এই এমপি প্রার্থীদের প্রত্যেকেই সেই সময়ে পরিচিতি পেয়েছিল সন্ত্রাসের গডফাদার হিসেবে। ফ্রাঙ্কেনস্টাইনের সেই দানবের মতোই এরা সারা দেশ দাঁপিয়ে বেড়িয়েছে সশস্ত্র অবস্থায়। অবৈধ অস্ত্রবাজদের ভয়ে দেশের মানুষ তখন ছিল ভীতসন্ত্রস্ত। ১৯৯৬ সালে আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় আসার পর থেকেই ফ্রিডম পার্টির এই গডফাদাররা গা ঢাকা দিতে শুরু করে। সংশিষ্টরা বলছেন, ফ্রিডম পার্টির দেশের অভ্যন্তরে প্রকাশ্যে না থাকলেও গোপনে ঘাপটি মেরে রয়েছে। বিদেশে রয়েছে তারা প্রকাশ্যেই। তারা এখনো নানা কর্মসূচি পালন করছে বিভিন্ন দেশে। সেসব খবর আবার ছড়িয়ে দিচ্ছে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমগুলোয়। এদের অধিকাংশ এখনো বহাল। কেউ রয়েছে ব্যবসা নিয়ে, কেউ রাজনীতির বাইরে। আবার কেউ কেউ নিজ এলাকা ছেড়ে অন্য এলাকায় আত্মগোপনে রয়েছে। কেউ বিদেশে, আবার কেউ মারা গেছে। আবার কেউ রাজনৈতিক ভোল পাল্টে অন্য দলে ভিড়েছে। তবে সবচেয়ে আশঙ্কাজনক খবর হলো, ফ্রিডম পার্টির এক সময়ের সামনের সারির নেতারা অনেকেই আওয়ামী লীগ নেতাদের ছত্রচ্ছায়ায় থেকে ব্যবসাপাতি করে পকেট ফুলিয়েছে।
সূত্র : বাংলাদেশ প্রতিদিন